عقيدة
শব্দটি নিয়ে বলতে গেলে স্পষ্ট করেই বলছি, তা হলো ইসলামের স্ক্রিপ্ট সমূহে তা অপরিচিত শব্দ নয়।
কুরআনে বর্ণিত عقود (মাইদাহঃ১)
ও ﴿ وَالَّذِينَ عَقَدَتْ أَيْمَانُكُمْ ﴾[ النِّساء : 33 ] এবং ﴿
وَلَكِن يُؤَاخِذُكُم بِمَا عَقَّدتُّمُ الأيمان ﴾[ المَائدة
এগুলোর ব্যবহার অনিবার্য করে যে,
আক্বীদাহ শব্দটির ব্যবহার আছে কুরআনে। যার অর্থ, অন্তরের এমন শক্ত সিদ্ধান্ত যা থেকে ফেরা হয়না। হাদীসে
لاَ يَعْتَقِدُ قَلْبُ مُسْلِمٍ عَلَى ثَلاَثِ خِصَالٍ إِلاَّ دَخَلَ الْجَنَّةَ
অর্থাৎ কোন মুসলিমের মন তিনটি বিষয় শক্ত ভাবে ধারণ করলে জান্নাতে যাবে……………, الدارمي (1/302-303، ط1، 1421هـ ، دار المغني
এই হাদিসে يعتقد শব্দটা আজকের যামানায় ব্যবহার করা অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে।
সাহাবী উবাই ইবনু কাআব (রা) বলেনঃ هلك أهل العقدة ورب الكعبة কাবার রাব্বের কসম আহলুল উক্বদাহগণ ধ্বংশ হয়েছে। ইবনু বাত্তাহ বলেনঃ এই আহলুল উক্বদাহ বলতে তিনি বুঝিয়েছেনঃ
الذين يعتقدون على الآراء، والأهواء অর্থাৎ ঐ সমস্ত লোক যারা নিজস্ব রায়, প্রবৃত্তিতে বিশ্বাস করে।
الإبانة الكبرى" لابن بطة (1/93، ط1، 1422هـ، دار الكتب العلمية ، برقم 207) )
এই শব্দটি সাহাবীগণের যুগে আরবি ভাষা ও সাহিত্যেও অজ্ঞাত ছিলোনা। কবি ক্বায়স বিন মুলাওয়ীহ (মৃঃ ৬৮হি) বলে গেছেনঃ
إِذِا العَيشُ لَم يَكدُر عَلَيَّ وَلَم يَمُـت ... يَزيدُ وَإِذ لي ذو العَقيدَةِ ناصِـحُ
জীবন আমার কাছে আবিলতায় ভরেনি, এখনও ইয়াযিদ মরেননি, আর আমার আছে আক্বীদার অধিকারী পরামর্শদাতা।
(ديوان قيس بن الملوح: 55، ط المطبعة الخديوية ببولاق)
এপর্যন্ত আমি বলতে চেয়েছি আক্বীদাহ শব্দটা পরবর্তি কালের আবিস্কার নয়, এর প্রয়োগ কুরআন হাদীসে, সাহাবিগণের ভাষ্যে অভিভাষ্যে, সাহিত্যের খাঁজে খাঁজে তার পরিচিতি ছিলো।
সাহাবীগণের সময়েই আসে ফিতনার নতুন নতুন দিক। তাদের অন্তর্ধানের সাথে সাথেই ঈমানের নানা বিষয়ের সাথে বিভিন্ন বিশ্বাসের ঢেও এসে লাগে। এতদিন ঈমান বলতে যা বুঝানো হতো, তার পরিধি ও বৃত্তের বাইরে নানা অনুসঙ্গ চলে আসতে লাগলো।
যেমনঃ ঈমানদার পাপ করলেই কাফির হয়ে যাবে। মানূষের বিচার ফয়সালা শুনলেই বা মানলেই কাফির হতে হবে। দেশের রাস্ট্রপ্রধান মাত্র নবী বংশের ডেভিনিটি নিয়েই আসবে, ফলে আলি, হাসান, হুসায়ন রিদওয়ানুল্লাহি আজমাঈনগণই মুসলিম বিশ্বের নেতা হতে পারেন, আর কেও নয়। ইসলামের আক্বল হয়ে উঠলো “নক্বলের” উপর প্রাধান্য লাভকারী।
এই সব দেখা গেলো ইবনে আব্বাসের জীবদ্দশায়, আনাস ইবন মালিকের জীবনেই, ইবন উমারের সামনেই। (রাদিয়াল্লাহু আনহুম)। তারা এইসব বিষয়ে আলোচনা শুরু করে দেন।
কিন্তু এই সংক্রান্ত বিষয় সম্বলিত জ্ঞানের সর্বপ্রথম শাখা হিসেবে জন্ম লাভ করে ইমাম আবু হানীফার হাতে, যিনি সর্বসম্মতিক্রমে তাবেঈর মর্যাদা রাখতেন। তিনি এর নাম আক্বীদাহ দেন নি, দিয়েছেন, “আলফিক্বহ আল আকবর” বা সেরা ফিক্বহ। যেটাকে ইমাম আবু জাফর ত্বহাওয়ী (৩২১হি) আক্বীদা নামেই ডেকেছেন তার আক্বীদাহ ত্বাহাওয়ীয়্যাহতে।
তিনি বলেছেনঃ
هذا ذكر بيان عقيدة أهل السنة والجماعة على مذهب فقهاء الملة، أبو حنيفة النعمان بن ثابت الكوفي، وأبو يوسف يعقوب بن إبراهيم الأنصاري، وأبي عبد الله محمد بن الحسن الشيباني، رضوان الله عليهم أجمعين، وما يعتقدون من أصول الدين ويدينون به رب العالمين
অর্থাৎ এটা মিল্লাতের ফুক্বাহাগ্ণ আবু হানীফা আন নুমান ইবন সাবিত আলকুফী, আবু ইউসুফ আলআনসারী, মুহাম্মাদ ইবন আলহাসান আশশায়বানী রিদওয়ানুল্লাহি আলাইহি আজমাঈনের মাযহাবাস্রিত আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামায়াতের আক্বীদার বর্ণনা। তাঁরা দীনের মৌলিক বিষয়ে যে আক্বীদা রাখতেন ও আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের যে দ্বীন তার মেনে চলতেন তার আলোচনা………
ইমাম আবুহানীফার সমসাময়িক ইমাম আলআওযাঈ (১৫৭হি) এর লেখা اعتقاد সুফইয়ান আসসাওরির (১৬১হি) এর اعتقاد সহ আরো লেখার সন্ধান পাওয়া যায়। যেগুলোর উল্লেখ ইমাম লালকাঈ তার গ্রন্থে “ই’তিক্বাদাত” আহলুস সুন্নাহ বলে উল্লেখ করেছেন। এদের পরে তো আক্বীদাহ বিষয়টা থিউলোজী স্ট্যাডীর একটা স্বতন্ত্র শাখা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
এখন এসে এই বিষয়টাকে বলা হচ্ছে উম্মাতকে দ্বিধা বিভক্তের হাতিয়ার,। এ কথা ইসলামি সভ্যতার মর্মমূলে আঘাত করে। কারণ ইসলামি সভ্যতার উন্মেষ হয় ইসলাম নামক সাগরের স্রোত দিয়ে যখন নানা নদ- নদীর শাখা মানব জমিনে ছড়িয়ে পড়ে, ও তাদেরকে উন্নতির দিকে নিয়ে যায়। ইসলামের সাগর থেকে বয়ে আসা এই বিজ্ঞানকে হেয় করা, এর অন্যান্য শাখা প্রশাখাকেও হেয় করার নামান্তর।
হাদীস বিজ্ঞানের নানা শাখা হয়েছে পরে। ফিক্বহ বিজ্ঞানের আবির্ভাব ও হয়েছে সভ্যতার ঊষা লগ্নে। ভাষা বিজ্ঞানের উন্নতি হয়েছে ইসলামের দ্যুতি ছড়ানোর সাথে সাথে। কুরআনিক সায়েন্সেস এর উদ্ভব হয়েছে তাবেঈদের মাধ্যমে। এইসব জ্ঞান আসার পর তার পথে বিকৃতি ও এসেছে অনেক। এগুলোকে মিস ইউজও করা হয়েছে বিভিন্ন খানে ও বিভিন্ন সমাজে। সেই বিকৃতির হাওয়া লাগিয়ে, ইসলামি বিজ্ঞানের এই শাখাকে উম্মাতের ধ্বংশের মূল মনে করতে হবে?