ইনতিকাল করেছেন ডঃ প্রফেসর খুরশিদ আহমাদ

ড. আব্দুস সালাম আজাদী

রাতেই সংবাদটা পেয়েছি, আমার প্রিয় মুরুব্বি ও মেনটর প্রফেসর ডঃ খুরশিদ আহমাদ ইনতিকাল করেছেন। আজ ১৩ই এপ্রিল ২০২৫ রবিবার রাতে তিনি আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে চলে গেলেন। রাত জেগে লেখা লেখিতে আমার অদম্য ইচ্ছা থাকলেও শরীরে শক্তি আর নেই, ফলে ঘুম থেকে উঠেই তাকে নিয়ে লিখতে চাচ্ছি। 


জন্ম ও পরিবারঃ   
তিনি ২৩শে মার্চ ১৯৩২ এ দিল্লিতে জন্ম গ্রহন করেন। বাবার নাম ছিলো নাযির আহমাদ কুরেশি, মায়ের নাম ছিল সারওয়ার জাহান। বাবা কুরাশ বংশের ছিলেন, এজন্য পিতৃ পুরুষের অনেকেই এমনকি তার বাবা কুরেশি হিসেবে সম্বোধিত হতেন, তার চাচা শাহ আব্দুল্লাহ কুরেশি ছিলেন ব্যরিস্টার। স্পেসিফিক ভাবে বলতে গেলে তিনি সায়্যিদুনা আবু বকর সিদ্দিক (রা) এর বংশেরই, এবং হিজরি ৫ম শতকে তারা ভারতে আসেন। ভারতে বংশ পরম্পরায় তারা অনেক বড় পদ মর্যাদার অধিকারি ছিলো। তার আম্মা ছিলেন তুর্কি বংশোদ্ভুত। তারাও ছিলেন খুব সম্ভ্রান্ত, এবং তার ভায়েরা ছিলেন ভূভারতের পরিচিত মুখ।   

বাবা আলিম না হলেও তিনি আলিগড় থেকে ল পাস করেছেন, এবং তদকালিন মুসলিম জাতির কাছে পরিচিত ছিলেন। ব্যবসায়ী ছিলেন, এবং প্রথমে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ, পরে খিলাফত আন্দোলন এবং তার পরে মুসলিম লীগের সাথে ওতপ্রোত হয়ে যান। সময়ে ভারতের সেরা আলিমগণের সাথে এই বাড়ির সম্পর্ক ছিলো গভীর, তারা সবাই এই বাড়িতে গিয়েছেন।  

বেড়ে ওঠা ও শিক্ষা জীবনঃ 
অনেক ছোট বেলা থেকে বাসায় তাকে কুরআন পোড়ানো হয়, ইসলামের মৌলিক বিষয় একটু একটু করে শেখানো হয়। এরপরে তাকে ভর্তি করানো হয় পাব্লিক প্রাইমারি স্কুলে। সেখান থেকে যান কারোল বাগ হাইস্কুলে। তিনি A লেভেল করতে ভর্তি হন আজমেরিগেইট এংলো-এরাবিক “দিল্লি কলেজে”। এখানে দ্বিতীয় বছর পড়তে পড়তে ১৯৪৭ ভারত বিভক্তি আসে। যেহেতু তার আব্বা ছিলেন মুসলিমলীগের নেতৃস্থানীয়, সেহেতু ভারত থেকে হিজরাত না করলে যে কোন মুহুর্তে তাদের উপর রক্ত বহানোর উসিলা আসতে পারে। এজন্য তাদেরকে পাকিস্তানে চলে যেতে হয়। 

১৯৪৭ সাল থেকে প্রায় একবছর তার স্কুলে যাওয়া হয়নি, ফলে তার আব্বা মুহাম্মাদ আকরামউল্লাহ নামের একজন ইসলাম ও সাধারণজ্ঞানে পারংগম ব্যক্তিকে গৃহ শিক্ষক হিসেবে রেখে দেন। এখানে উল্লেখ যোগ্য যে, তিনি তার শিক্ষা জীবনে কোন স্তরেই প্রথম ছাড়া দ্বিতীয় হননি। 

১৯৪৮ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারিতে তিনি সপরিবারে পাকিস্তান করাচিতে চলে আসেন। টি আই (তালিমুল ইসলাম) কলেজে তিনি A লেভেলের জন্য ভর্তি হন। এরপর করাচি ইউনিভার্সিটি থেকে বি কম (অনার্স ইন কমার্স এন্ড ইকোনোমিক্স) পাস করেন। ১৯৫৬ সনে সেখান থেকে এম এ ডিগ্রী নেন। তার থিসিস ছিলো Adam smith এর থিউরি চ্যালেঞ্জ করে। ১৯৫৮ সনে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে LLB ডিগ্রী নেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়েই তারপর তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন। এই সময়ে এখান থেকে ১৯৬২ ইসলামি স্টাডীজেও এম এ ডিগ্রী নেন।
     
ইসলামি জীবন ধারা ও বিলাত গমনঃ 
পারিবারিক ঐতিহ্যের সূত্র ধরে ছাত্র জীবনেই তিনি ইসলামি জীবন যাপনে অভ্যস্ত হন। ১৯৪৯ সালে জামায়াতে ইসলামি ছাত্র উইং শক্তিশালী করার প্রয়াস পায়। এই সময় তিনিও যোগদেন জমিয়তে তালাবাতে। এর প্রথম সভাপতি নিজামির বন্ধু ছিলেন খুরশিদ আহমাদের ভাই আহমাদ যমীর। তিনি হন দ্বিতীয় সভাপতি। এর পরে হন জাফর আনসারী। তারপরে হন খুররম মুরাদ এবং খুরশিদ আহমাদ ছিলেন পঞ্চম কেন্দ্রীয় সভাপতি। তিনি তখন করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তার মেধার স্বীকৃতি স্বরূপ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার পর তিনি জামাআতে ইসলামিতে যোগদান করেন এবং একবছরের মধ্যেই শুরা মেম্বর হয়ে যান। এখানে ১৯৫৮ সালে তিনি Islamic Research Academy প্রতিষ্ঠা করেন। 
    
তিনি ছিলেন অসামান্য মেধার অধিকারী ফলে, তিনি চাইলেন পি এইচ ডি বৃটেইনে শেষ করবেন। ১৯৬২ সালে তিনি সরকারি বৃত্তি নিয়ে বৃটেইনের পোর্টস মাউথে পি এইচডি শুরু করেন এবং ১৯৬৮ সনে ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেন। এই বিশ্ববিদ্যলয়ে তিনি অর্থনৈতিক দর্শন ও আধুনিক দর্শনের উপর শিক্ষকতা শুরু করেন। 

তিনি যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেনঃ 
তিনি প্রথমতঃ ও প্রধানতঃ তার পিতার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। শিক্ষকগণের মাধ্যমেও তিনি নিজ পথ রচনা করেছেন। তিনি ব্যাপক ভাবে আল্লামাহ ইকবাল দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। মাওলানা আবুল কালাম আযাদ মাওলানা মাওদূদি ও মুহাম্মাদ আসাদের লেখনী তাকে অত্যন্ত প্রগাঢ় ভাবে আকর্ষণ করেছে। তাদের চিন্তার প্রতিফলন তার লেখা লেখনীতে, তার আচার আচরণে, তার চিন্তা ও মননে সর্বত্র দেখতে পাবেন।   

বিলাতে ইসলামি আন্দোলনের সূচনাঃ 
মাওলানা মাওদূদি তার দাওয়াতি কাজকে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে সারা দুনিয়েয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পাকিস্তানিদের মাঝে জামাআত সংগঠনের শাখা খোলার চেষ্টা করতে থাকেন। ইতিমধ্যে বিলেতে তার দ্বারা প্রভাবিত অনেক লোক এসে গেছেন এবং বিভিন্ন স্থানে তাদের হাতে মসজিদ মাদ্রাসা গড়ে ওঠা শুরু হলো। ১৯৬২ সনে UK Islamic Mission প্রতিষ্ঠিত হয়। 

তিনি তাদেরকে ৩টি সেক্টরে কাজ করার তাকিদ দেনঃ 
প্রথমতঃ ঐ সময় পর্যন্ত যারা পাকিস্তান ও ভারত থেকে বৃটেইনে গেছে তাদের মধ্যে জামাআতের মেথডোলজিতে সঙ্ঘবদ্ধ রাখা। 
দ্বিতীয়তঃ মুসলিমদের যে বা যারা বৃটেইনে আসে, তাদেরকে দীনের পথে রাখার আপ্রান চেষ্টা করা ও সংঘবদ্ধ ভাবে রেখে বৃহত্তর মুসলিম কম্যুনিটি গঠনের জন্য প্রস্তুত করা। 
এবং তৃতীয়তঃ স্থানীয়দের মাঝে দীনের দাওয়াত ছড়িয়ে দিয়ে মুসলিম কম্যুনিটিকে শক্তিশালী করে তোলা।    
 
অধ্যাপক খুরশিদ আহমাদ যেহেতু জামাআতে ইসলামির শুরা মেম্বর ছিলেন, কাজেই মাওলানা মাওদূদী (র) তাকে এখানেই কাজ করতে নির্দেশ দিলেন। ইতিপূর্বে এখানে ইখওয়ানের কাজ শুরু হয়েছে, পৃথিবীর অন্যান্য দেশে পরিচালিত ইসলামি দলগুলোর সক্রীয় সদস্যগণ এখানে আসা শুরু করেছেন, কাজেই খুরশিদ আহমাদদের এখানে কাজ করতে কোন সমস্যা হলোনা। 

মাওলানা মাওদূদি ১৯৬৮ সনে বৃটেইনে আসেন। তখন সারা বিশ্ব বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যু বিশেষ করে ইসলাম ও মুসলমানদের নিয়ে টালমাটাল। মার্টিন লুথার কিং নিহত হয়েছেন, প্যারিসে রাজনৈতিক সহিংসতা চলছে, ইরাকের কর্ণেল আরিফকে বিতাড়িত করা হয়েছে, পাকিস্তানে আইউব হটাও আন্দোলন জোরদার হয়েছে। সুদানের আর্মি এজিটেশান, লিবিয়ায় কর্ণেল গাদ্দাফির ক্ষমতা গ্রহনও এই সময়ের দিকে। মাওলানা মাউদূদি এখানে এসে দেখলেন ইসলাম প্রচারের জন্য, ইসলামি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার জন্য, সর্বোপরি এখানে থাকা মুসলিম অবস্থানকে শক্ত রাখার জন্য এখানে দাঈ ইলাল্লাহের বেশি বেশি আসা প্রয়োজন। তিনি ডঃ খুরশিদ আহমাদকে সে জন্য এখানে স্থায়ী ভাবে থেকে যাওয়ার নির্দেশ দিলেন। 

তার পরিবারঃ 
তার দাদা মৌলভি বারাকাত আলি ছিলেন বৃটিস আমলে আইনজীবী, চাচা আব্দুল্লাহ কুরেশি ছিলেন ব্যরিস্টার। বাবা ছিলেন আলিগড় থেকে আইন পাস। মায়ের বাবা সাহেবযাদা ফায়যুল্লাহ আফেন্দি ছিলেন তুর্কির। 
তারা ৫ভাই। বড় ভাই আফতাব আলি অল্প বয়সে মারা যান। মেঝ ভাই আহমাদ যামির ছিলেন নৌবাহনীর অনেক বড় অফিসার। ছাত্র জীবনে তিনি জমিয়তের কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন। তার ছোট দুইজন। একজন মোমতায আহমাদ, তিনি ছিলেন খুব মেধাবী সাংবাদিক, কিন্তু অল্প বয়সে বিমান দূর্ঘটনায় মারা যান। একেবারে ছোট ভাই ডঃ আনিস আহমাদ। তার কাছে আমরা মালয়েশিয়াতে পড়েছি। তিনি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন। এবং পাকিস্তানের রিফাহ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভি সি ও ছিলেন। 

প্রফেসর খুরশিদের অবদানঃ 
প্রফেসর আহমাদ ছিলে বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী। নিচের ক্ষেত্রগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে তার প্রতিভার দিগন্ত কত বিস্তৃত ছিলো। 

ক- সাংবাদিকতাঃ 
তিনি সাংবাদিকতা দিয়েই তার সমুজ্জ্বল প্রতিভার প্রথম স্বাক্ষর রেখেছেন। ছাত্রজীবনেই তিনি এই কাজ শুরু করেন এবং গোটা পাকিস্তানে ক্ষুরধার লেখনি দিয়ে চমকে দেন। 
ছাত্র সংগঠনের মুখপত্র “The Students voice” ১৯৪৯ থেকে, The new Era” ১৯৫৫-৫৬, The Voice of Islam ১৯৫৭-৬৪, Chiragh-e-Rah ১৯৫৭-৬৮, The Iqbal Review, ১৯৬০-৬৪ এর সম্পাদনায় কাজ করেছেন।   
    
খ- ইসলামি অর্থনীতিঃ  
যে সব প্রফেসর ও দার্শনিকগণকে Fathers of Islamic Economics বলা হয়, তিনি ছিলেন তাদের মধ্যে গণ্য। তিনি ইসলামকে শুধু ধর্ম হিসেবে না দেখে মনে করতেন, it has been a spiritual, intellectual, ideological and civilizational movement তিনি এইজন্য মুসলিমদেরকে সার্বিক সেক্টরে কাজ করা অপরিহার্য মনে কর‍তেন। 

তিনি বলেছেন, ইসলামি অর্থনীতি মানব জীবনের যাবতীয় দিক ও বিভাগকে শামিল করে। এখানে উৎপাদন নিয়ে কথা বলা হয়, বিতরণ দিক নির্দেশনা দেয়া হয়, ধনিক শ্রেণী ও দরিদ্র শ্রেণীর মাঝে তোলা দেয়াল ভাঙার জযবাহ তোলা হয়, এখানে শুরাঈ নিযামে অর্থনৈতিক অঙ্গন সমূহের নিত্য নতুন সমস্যার সমস্যার সমাধান করা হয়। 

তিনি ১৯৭৬ সালে জেদ্দায় ইসলামি অর্থনীতি সম্মেলনে ইসলামি অর্থনীতির মূল দর্শন তুলে ধরেন। তার পরের বছর মক্কা সম্মেলনে সেই রূপরেখাকে আরো বিকশিত করেন। ১৯৮০ সনে এই দর্শনের আলোকে পাকিস্তানে ইসলামের অর্থনৈতিক জীবন ঢেলে সাজানোর প্রয়াস পায়। কিন্তু তা কিছু দূর যেয়ে দূর্ভাগ্যভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। এর পরে সারা দুনিয়ায় ইসলামি ব্যাঙ্ক পদ্ধতি চালুর হিড়িক পড়ে যায়। তিনি, ওমর চাপড়া এবং অন্যান্য স্কলারগণ এর পেছনে অনেক সময়, শ্রম ও বুদ্ধি ঢেলেছেন। যদিও তা সম্পূর্ণ ভাবে ইসলামি করণ করা যায়নি কিন্তু আজ হারাম সূদের বিপরীতে হালাল বায়বসায়িক ব্যাঙ্কগুলো মুসলমানদের সামনে উত্তম অল্টারনেটিভ দান করেছে। এই সব ইসলামি ব্যাঙ্কগুলো পূর্ণ ইসলামি না করতে পারার কারণ কয়েকটা কারণ আছে। তিনি তিন কারণ এক পর্যায়ে উল্লেখ করেছিলেনঃ 

প্রথমতঃ এটি মাকাসিদে শারিয়াহ—অর্থাৎ রিবা নিষিদ্ধ করার পেছনে শরিয়াতের প্রকৃত উদ্দেশ্য—এবং ইসলামী অর্থনীতি ও ইসলামী ব্যাংকিং ও ফাইন্যান্সের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গিকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করেছে।

দ্বিতীয়তঃ তারা কিছু নির্দিষ্ট ফিকহি পদ্ধতির উপর অতিরিক্ত নির্ভর করেছে, যদিও এই ফিকহি পদ্ধতিগুলো নিজেরাই বৈধ এবং আজও বৈধ, তবে সেগুলো অনেক শর্তের অধীন, যা ঐতিহাসিক এবং বাস্তব উভয় দিক থেকেই কষ্টসাধ্য। 

তৃতীয়তঃ এটি হলো ইসলামি শরীয়াহর মূলনীতি প্রয়োগে ব্যর্থতা দেখিয়েছে, এবং যাকে আমি বলি কারিগরি দক্ষতা, শারিয়াহ বোঝাপড়া ও জনসচেতনতা, এ সবের প্রচুর ঘাটতি রয়েছে। কারণ, ইসলামী ব্যাংকিংয়ের সাফল্য নির্ভর করে:
1- একটি স্পষ্ট দৃষ্টিভঙ্গি ও একটি পরিষ্কার রোডম্যাপের উপর; 
2- আমি যা কিছু করা হচ্ছে তা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখ্যান করছি না, তবে আমি এটিকে অপর্যাপ্ত মনে করি। এবং শারিয়াহ ও ইসলামী ব্যাংকিংয়ের উদ্দেশ্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে মনে করিনা। 
3- আমরা যদি এমন একটি মানবসম্পদ তৈরি করতে পারি যারা প্রেরণাদানকারী হবে ও পেশাগতভাবে প্রশিক্ষিত হবে এবং ইসলামী ফাইন্যান্স ও ব্যাংকিং, ইসলামী অর্থনীতি ও তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে যোগ্য হবে, তখনই কেবল প্রকৃত সফলতা আসবে বলে মনে হয়।   

কিন্তু তাই বলে তিনি এটার মাধ্যমে আয়কে হারাম বলতে নারায। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, এটি বিয়ে ও যেনা করার সাথে তুলনা করা যায়। বিয়েতে ভুল করলেও, সেখানে এক আধটু গুনাহের কাজ হলেও দাম্পত্য জীবনকে হারাম রিলেশন বলা যায়না। 

ইসলামি অর্থনীতির ক্ষেত্রে তার আরেকটি বড় অবদান হলো আজ যে পৃথিবীর ৫০ টির বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামি অর্থনীতি পড়ানো হয় তার মূল কারিগর তিনি, এবং তারই প্রচেষ্টা।  

 গ- ইসলামি শিক্ষাঃ 
তার সারা জীবনের প্রধান ক্ষেত্র হলো শিক্ষা, শিক্ষণ ও প্রশিক্ষণ। এর সাথে যুক্ত হয়েছে তারবিয়্যাহ দর্শন। তিনি বিশ্বাস করেনঃ 
১- ইসলাম আমাদের শুধু শিক্ষা এবং শিখতে আদেশ করেনা বরং জ্ঞান আহরণ করার জন্যও আদেশ দেয়। এবং সেই জ্ঞান শুধু দীনের জ্ঞান নয়, মানব জীবনের সকল দিক ও বিভাগের জ্ঞান এতে শামিল। তিনি কুরআনের সূরাহ আল-আলাক্বের এই আয়াতগুলো সব সময় সামনে আনেনঃ   
 اقْرَأْ بِاسْمِ رَبِّكَ الَّذِي خَلَقَ ‎﴿١﴾‏ خَلَقَ الْإِنسَانَ مِنْ عَلَقٍ ‎﴿٢﴾‏ اقْرَأْ وَرَبُّكَ الْأَكْرَمُ ‎﴿٣﴾‏ الَّذِي عَلَّمَ بِالْقَلَمِ ‎﴿٤﴾‏ عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ ‎﴿٥﴾
অর্থঃ পাঠ করুন আপনার পালনকর্তার নামে যিনি সৃষ্টি করেছেন। সৃষ্টি করেছেন মানুষকে জমাট রক্ত থেকে। পাঠ করুন, আপনার পালনকর্তা মহা দয়ালু। যিনি কলমের মাধ্যমে শিক্ষা দিয়েছেন। শিক্ষা দিয়েছেন মানুষকে যা সে জানত না।
তিনি মনে করেন ইসলামি শিক্ষার সকল মূলনীতি এই আয়াতগুলোতে বলা হয়েছেঃ  
একঃ এই শিক্ষানীতির মূল ভিত্তি হবে আল্লাহর উপর, মানে কুরআন ও হাদীসের উপর। 
দুইঃ এই শিক্ষানীতির মূল কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে আল্লাহর রুবুবিয়্যাতকে উদ্ঘাটন। এখানে একটার কথা বলে দেয়া হয়েছে, خَلَقَ মানে যিনি সৃষ্টি করেছেন। তাবৎ সৃষ্টিজগতের সামগ্রিক সৃষ্টির physical দিক এই শিক্ষানীতির চারণ ভূমি। এরপর عَلَق বলে মানুষ ও প্রাণী জগতের biological দিক সমূহ সামনে এনেছেন। তারপরে علَّمَ بالقلَم বলে শুধু কলম নয়, টেকনোলজির সামগ্রিক ব্যবহারকে এখানে আনা হয়েছে। জ্ঞান সংরক্ষণ, আহরণ, গবেষণা ইত্যাদির জন্য এই টেকনোলজিক্যাল দিক আবশ্যক। 
তিনঃ মানুষ যদি অজানা বিষয় না জানে, এবং শুধু পেশি শক্তি নির্ভর হয়ে যায় সেই মানুষ, বা মানুষজাতি বেশি দিন টিকে থাকবেনা। আল্লাহ এই কথাটাই বলেছেনঃ  
عَلَّمَ الْإِنسَانَ مَا لَمْ يَعْلَمْ ‎
বক্তব্যে। তিনি বুঝেছেন, যদি আমাদের উম্মাহকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে হয় তাহলে ফিজিক্যাল, অর্থনৈতিক, মিলিটারি ইত্যাদিতে শক্তিশালী করতে হবে, আর এর জন্য এডুকেশান ছাড়া উপায় নেই। 

তিনি তার শিক্ষা পলিসিতে বলতে চেয়েছেনঃ 
১- আমাদের শত শত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানাতে হবে। তা হবে সামগ্রিকঃ প্রাইমারি, সেকন্ডারি, কলেজ ও ইউনিভার্সিটি পর্যায়ে।  
২- আমাদের অগণিত রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা হবে আমাদের থিঙ্কট্যাঙ্ক। 
৩- শিক্ষা ও প্রশিক্ষণে আমাদের বাড়াতে হবে কম্যুনিকেশানের টুলস। মিডিয়া, ডায়ালগ ডিবেইট, সেমিনার সিম্পোজিয়াম, মাল্টি মিডিয়া প্লাটফরম ইত্যাদি হাতিয়ার ব্যবহারে আমাদের যোগ্যতা আনতে হবে সবচেয়ে বেশি।   

ঘ- রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠাঃ 
তিনি মুসলিম সমাজের যেন তেন বিষয়ের গবেষণা করা পছন্দ করেন না। মার্কফিল্ডে তার গবেষণার টাইটেলগুলো দেখলে বুঝবেন তিনি কি ধরণের গবেষণা করতে বলেন। তিনি মনে করেন, গবেষণা করতে হলে, বা গবেষণার জন্য সেন্টার প্রতিষ্ঠা করতে হলে তিনটি মূলনীতি অবশ্যই পালন করতে হবেঃ 
একঃ দুনিয়ার পলিসি সমূহকে পরীক্ষা ও নীরিক্ষা করতে হবে। 
দুইঃ ইসলামকে উপজীব্য করে দুনিয়ার বিভিন্ন পলিসির অল্টারনেটিভ দিতে হবে। 
তিনঃ নতুন নতুন পলিসি উদ্ভাবন করতে হবে যা হবে এক্সপার্টদের মতামতকে ভিত্তি করে, এবং মাঠ পর্যায়ে পরীক্ষা ও নীরিক্ষার মাধ্যমে প্রমানিত সত্যের উপর উন্নিত করে।  

ঙ- গ্রন্থ ও গবেষণাঃ 
তিনি ৭০টির অধিক বই লিখেছেন, অনুবাদ করেছেন বা সম্পাদনা করেছেন। আর প্রত্যেকটা বই একাডেমিক অঙ্গনে অনেক অনেক পরিচিতি লাভ করেছে। তার গবেষণার প্রধান ক্ষেত্র হলো ইসলামি স্টাডীজ, ইসলামি অর্থনীতি, ইসলামি রাজনীতি, ও ইসলামি বুদ্ধিজীবিতা ও দর্শন। 
তিনি একশতের বেশি আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ গ্রহন করেছেন এবং প্রবন্ধ পেশ করেছেন। বিভিন্ন প্রখ্যাত জার্ণালে তার লেখা প্রবন্ধ শত শত। 

প্রাতিষ্ঠানিক দ্বায়িত্বঃ 

আগেই তার হাতে গড়া Islamic research Academy এর কথা উল্লেখ করেছি। 

১৯৭৩ সালে প্রতিষ্ঠা তিনি খুররম মুরাদ (র) এর সাথে প্রতিষ্ঠা করেন লেইস্টারের মার্ক ফিল্ডে ইসলামিক ফাউন্ডেশান যা এখন একটা পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক ইউনভার্সিটি। নাম হলো Markfield Institute for Higher Education (MIHE). হাজার হাজার ছাত্র ছাত্রী এখানে থেকে ব্যচেলার, মাস্টার্স ও পিএচডি নিয়েছেন। 

১৯৭৪ সালে তিনি Standing Conference on Jews, Christians & Muslims in Europe এর ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ১৯৭৬ এ প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। 

১৯৭৬ সাল থেকে তিনি জেদ্দার কিং আব্দুল আযিয ইউনিভার্সিটির ট্রাস্টি, এবং ইসলামি অর্থনীতি বিভাগের সুপ্রিম এডভাইজার হিসেবে নিয়োগ পান। 

১৯৭৮ সনে তিনি পাকিস্তানে বিজনেস ও প্লানিং মন্ত্রিত্ব লাভ করেন। এই সময় তিনি প্লানিং কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান ছিলেন। 

তিনি ১৯৭৯ সালে পাকিস্তানে IPS (institute of Policy Studies) নামে একটি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন এবং চেয়ারম্যান হিসেবে দ্বায়িত্ব পান। 

ইসলামাবাদে ইন্টারন্যশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটির বোর্ড অফ ট্রাস্টির সদস্য মনোনিত হন, এবং সেখানে International Institute of Islamic Economics এর চেয়ারম্যান হিসেবে কাজ করেন।

১৯৮৫ সনে তিনি পাকিস্তানের সিনেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন, ও সরকারের প্লানিং কমিটির ইসলামাইজান প্রসেসের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত হন। 

১৯৮৭ সনে তিনি আম্মানের Foundation Council Royal Academy for Islamic Civilisation এর সদস্য মনোনিত হন। 

এর পরের বছর ১৯৮৮ সনে তিনি IDB এর International Review Committee er সদস্য নিযুক্ত হন। 

২০০২ থেকে তিনি আবার পাকিস্তানের সিনেটর হন এবং ২০১২ সাল পর্যন্ত সেই পদে বহাল থাকেন। 

তিনি লাহোরে ILM (Institute of Learning and Management) প্রতিষ্ঠা করেন, যেটা এখন ULM নাম ধারণ করে পরিপূর্ণ বিশ্ববিদ্যলায়ে রূপান্তরিত হয়েছে। 

এই ছাড়া তিনি লোক্যাল, ন্যাশনাল ও ইন্টারন্যাশনাল বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি, সামাজিক ও সাহিত্যিক পরিমন্ডলে দ্বায়িত্বশিল পর্যায়ে কাজ করেছেন। 
  
তার অবদানের স্বীকৃতিঃ 
তিনি তার অনবদ্য অবদানের জন্য এ পর্যন্ত অনেক স্বীকৃতি অর্জন করেছেন। তন্মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলোঃ 
১- ইসলামি অর্থনীতিতে অবদানের জন্য IDB এওয়ার্ড, ১৯৮৮
২- ইসলামে অসামান্য অবদানের জন্য কিং ফয়সাল প্রাইজ ১৯৮৯
৩- আমেরিকান ফাইনান্স হাউস (LARIBA) কর্তৃক পঞ্চম বাৎসরিক প্রাইজ 
৪- ২০০২ সনে ইউনিভার্সিটি মালায়ু থেকে, ২০০৩ সনে লাফবরো ইউনিভার্সিটি থেকে এবং ২০০৬ সনে ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি মালায়শিয়া থেকে ইসলামিক ইকোনমিক্সের উপর অনারারি ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেছেন। 
৫- জ্ঞানের ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের জন্য পাকিস্তান সরকার ২০১১ সালে তাকে সরকারের সর্বোচ্চ পদকঃ নিশান-ই-ইমতিয়ায লাভ করেন।
Created with