May 7 • শায়েখ ড.আব্দুস সালাম আজাদি
শায়খ সুলতান যাওক্ব আন-নাদাওয়ীর (রহঃ) ইন্তিকাল
শায়েখ ড.আব্দুস সালাম আজাদি
আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ
وَمَن نُّعَمِّرْهُ نُنَكِّسْهُ فِي الْخَلْقِ ، أَفَلَا يَعْقِلُونَ.
যাকে বয়স বাড়িয়েছি, সৃষ্টিতেও আমরা তাকে কমাতে থাকি, তারা কি বুঝেনা? আয়াতটা বারবার পড়লাম, বুঝার চেষ্টা করলাম। গত কয় দিনে যারা চলে গেছেন তাদের বিয়োগে হৃদয় ভেঙে যাচ্ছে, চোখ বর্ষা ঝরাচ্ছে, আর মন অতলান্ত নীলে হারিয়ে কষ্টের ঢেও গুনছে।
আমি ষাটের কাছাকাছি, আগে এমন ঘঠনা ঘটলে পাতার পর পাতা লিখতাম, ঢেওয়ের বালিয়াড়ি সাজাতাম, কেউ কাঁদতো, কেউ প্রশান্ত হতো, কেউ কমেন্টে অজস্র স্তুতির মালা পরাতো। এখন ঐ কাজ করতে যেয়ে দেহকে শক্তি ধার করতে হয়। আক্বলেরও ঘাটতি এসেছে। আগের লেখায় দর্শন থাকতো, মখমলের শব্দ সম্ভার থাকতো, আগুনের ফুলকি ছুটতো, শব্দ শুঁকে শুঁকে ব্যবহার করা যেতো। এখন শব্দের মিষ্টি চলে যেয়ে গরলের আধিক্য সেখানে। মানুষ বিক্ষত হয়, পাঠক-চিত্ত তিক্ততা বোধ করে, এবং হৃদয়ে আসে আবেগের মন্বন্তর।
যাকগে, আমি বলতে চাই, কেঊ শুনুক আর না শুনুক; আমি লিখতে চাই, তাই কেউ পড়ুক আর না পড়ুক; এবং আমি বলে যেতে চাই শায়খানা সুলতান যাওক্ব নাদাওয়ী (রহ) আমাদের মুসলিম উম্মাহর একজন কন্ট্রিবিউটর মুরব্বি ছিলেন। তিনি দিয়েছেন অনেক বেশি, নিয়েছেন কম। এমনকি দিতে দিতে ফতুর হয়েও তিনি নিতে চাইতেন না।
তিনি মহেশখালির মানুষ। তার জ্ঞানের আবিস্কার করেছিলেন প্রথমে তার বাবা। তারপরে তার উস্তাযগণ, এবং শেষে মুফতী আযীযুল হক রহিমাহুল্লাহুর নেক দৃষ্টি পড়ায় তিনি পটিয়া পড়তে সুযোগ পেয়েছিলেন। সেখানেই ফুটে ওঠে তার প্রতিভা, জ্ঞানের সৌরভ, ও দৃষ্টির প্রাখর্যতা। তিনি বাংলা, আরবি, উর্দু ও ফার্সির ফ্লুয়েন্ট হয়ে ওঠেন, এবং হাদীসের সনদ গ্রহন করেন। দেশের সেরা সেরা এমন সব আলিমের কাছ থেকে তিনি দীনি এলেমের সনদ লাভ করেন, যারা ইলমের জগতে ছিলেন এক এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। মুফতী আজীজুল হক, মুহাম্মাদ ইউনুস, ইসহাক গাযি, মুফতী ইবরাহিম, মাওলানা হুসায়ন আহমাদগণের মত উলামা।
বহির্বিশ্বের শায়খ ইউসুফ বিন্নুরি, আব্দুল্লাহ দারখাস্তী, ইমাম সাকারিয়া কান্দেহ্লভি, ইমাম আবুল হাসান আলী আন-নাদাওয়ী, আল্লামাহ মানজুর নো’মানি, আল্লামাহ ক্বারী মুহাম্মাদ তায়্যিব, শায়খ ফাখরুল হাসান, সিরিয়ার শায়খ আব্দুল ফাত্তাহ আবু গুদ্দাহ ও শায়খ আশেক ইলাহি আল-বরনীর (রাহিমাহুমুল্লাহু জামিয়ান) কাছে শিক্ষা ও সোহবত গ্রহন করেছেন।
আপনি তাজ্জব হন আর না হন, একজন মানুষ কত জ্ঞানপাগল হলে দুনিয়া সেরা আলিমগণের সান্নিধ্যে যেতে পারেন, তা সুলতান যাওক্ব সাহেবকে না দেখলে বুঝতে আমি কিন্তু পারতাম না।
তিনি অনেক মাদ্রাসায় পড়ায়েছেন। বেশ কিছু মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন তিনি। পটিয়া ও কিশোরগঞ্জের জামিয়া ইমদাদিয়া সহ অনেকগুলো মাদ্রাসায় পড়িয়ে বুঝতে পেরেছিলেন এখন বাংলাদেশে প্রয়োজন নতুন ধাচের মাদ্রাসা বিনির্মান, যেখানে চর্চিত হবে আল-ক্বাদীম আস সালিহ, ওয়াল জাদীদ আন-নাফি’ এর দর্শনে গঠিত শিক্ষা ব্যবস্থা, যার মূল কথা হবে পুরাতন ব্যবস্থার যা কিছু নেয়ার মত, আর নতুন ব্যবস্থায় যা কিছু উপকারী তার সমন্বয় করে ঢেলা সাজানো শিক্ষা ব্যবস্থা। যাতে একজন আধুনিক মানুষের একদিকে মনের খোরাক দেয়া যাবে, অন্য দিকে যুগের প্রয়োজন মেটানোর যোগ্যতা সম্পন্ন আলিম সমাজ তৈরি হবে। তিনি ভারতের নাদওয়াতুল উলামা, দেওবন্দ ও মদীনার ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিলেবাসের সমন্বয়ে প্রতিষ্ঠা করেন দারুল মা’আরিফ আল-ইসলামিয়্যাহ।
তিনি নিজ হাতে গড়ে তুলেছেন দেশের কিছু স্কলার যাদের দেখে আমরা আনন্দিত হই। প্রসিদ্ধদের মধ্যে হলেন শায়খ মুহাম্মাদ আয়্যুব, শায়খ আনোয়ার শাহ, শায়খ আব্দুল হালিম বুখারি, ডঃ প্রফেসর মাহফুযুর রহমান, ডঃ শায়খ রশীদ রাশেদ, শায়খ ডঃ জসীমুদ্দীন, শায়খ উবায়দুর রহমান নাদাওয়ী, ডঃ মুস্তাফা কামিল ও মাওলানা আফীফ ফুরকান প্রমুখ।
অনেক গ্রন্থের তিনি প্রণেতা। আমি যখন তার লেখা আরবি ও উর্দু কবিতা পড়েছি, তাজ্জব হয়ে গেছি। বাংলাদেশে বসে আরবি “তাফইলার” তথা ছন্দরীতি পূর্ণ প্রয়োগ করে কবি হিসেবে তিনি অনেক পূর্ণতা অর্জন করেছেন। তিনি আত ত্বরিক ইলাল ইনশা’, রিহলাতি ইলা আরদ্বিল জিহাদ,, আল্লামাহ আবুল হাসান নাদাওয়ী, শাযারাত মিন আন নুসূসিল আদাবিয়্যাহ, কুল্লিয়ায়াতু যাওক্ব, লাহনুল ফুয়াদ, কালিমাত মুখতারাহ এবং খুতাব মিনবারিয়্যাহ ইত্যাদি গ্রন্থ আরবি ভাষায় রচনা করেছেন। বাংলায় তার আত্মজীবনী লিখেছেন। লিখেছেন উর্দুভাষায় অনেক গ্রন্থ।
তবে আরবি ভাষায় তিনি এত বেশি অবদান রাখেন যার কারণে তিনি رابطة الأدب الإسلامي العالمية বা International League of Islamic Literature এর বাংলাদেশের প্রতিনিধি হন। এবং এরই সদস্য হিসেবে তিন অনেক অনেক দেশে সাহিত্য ও ইসলামি সমাবেশে বিশেষ মেহমান হয়ে ভ্রমন করেছেন। ভারত, পাকিস্থান, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, তুর্কি ইত্যাদি দেশে তিনি গিয়েছেন।
তিনি দুই ছেলে ও পাঁচ কন্যার জনক। প্রথম স্ত্রীর গর্ভে এক ছেলে ও ৪ মেয়ে এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর গর্ভে এক ছেলে ও এক মেয়ে জন্ম গ্রহন করেন।
তিনি নিজে “মানারুশ শারক” নামে একটা আরবি পত্রিকার সম্পাদনা করেছেন, ও বিভিন্ন দেশের গবেষণা ও সাহিত্য পত্রিকায় নিয়মিত লেখা লেখি করেছেন। আমি তার লেখা পড়েছি “আল-বা’স আল-ইসলামি, আল-মুজতামা’, মাজাল্লাতু রাবিতাহ আল-আদাব আল-ইসলামিতে। বাংলাদেশে জন্মেছেন, আরবি কোন ইউনিভার্সিটি পড়েন নি। অথচ অমন সাবলীল লেখা অনারব লেখকদের খুব কম জনের মধ্যেই পেয়েছি।
আমি ১৯৯৯ সালে চিটাগাং IIUC তে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করি। ঐ সময় সুযোগ হয়েছে চিটাগাঙের ভালো ভালো আলিমগণের সাহচর্যে আসা। যার কাছে আমি বেশি যত্ন-আত্মি, বেশি সম্মান ও ভালোবাসা পেয়েছি তিনি হলেন আল্লামাহ সুলতান যাওক্ব। তিনি মাঝে মাঝে তার মাদ্রাসায় ভালো ভালো সাহিত্য সেমিনার করতেন, নানান বিষয় নিয়ে ইসলামি আলোচনার ডাক দিতেন। তিনি আমাকেও ডাকতেন। তিনি জানতেন আমি শায়খ আবুল হাসান নাদাওয়ীর উপর গবেষণা করা মানুষ, এ জন্য হয়ত একটু বেশি তাওয়াজ্জুহ দিতেন। তাছাড়া তার ছাত্র ও জামাতা ডঃ জসীম ছিলেন মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার জুনিয়র। ফলে তারও মুহাব্বত পেতাম আলহামদুলিল্লাহ। ক্বাওমি “মা হাওলে” চিটাগাঙের IIUC কে একটু খারাপ নজরে দেখা হতো, কারণ তারা মনে করতেন এটা জামাআতের প্রতিষ্ঠান। অবশ্য অনেকেই ব্যক্তিগত ভাবে আমাদের সাথে অনেক সুন্দর সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন। তবে আল্লামাহ সুলতান যাওক্ব IIUC কে নিজের প্রতিষ্ঠান মনে করতেন। তিনি এর সদস্য ছিলেন, এবং তার ছাত্রদেরকে এখানে ভর্তি হতে অনুতসাহিত করতেন না।
বাংলাদেশের আলিম সমাজের মধ্যে তিনি অনেক রাজনীতি ও সমাজ সচেতন ছিলেন। শিক্ষা সংস্কার, সিলেবাস কারিকুলাম উন্নয়ন ইত্যাদি ক্ষেত্রে তিনি জীবন বিলিয়েছেন, সাথে সাথে দেশে রাজনৈতিক নানান কর্মকান্ডে তিনি সরাসরি শরিক হয়েছেন। ইসলাম বিরোধি অপশক্তির বিরুদ্ধে তিনি উচ্চকন্ঠ ছিলেন।
গত রমাদ্বানে আমরা জানতে পারি তিনি খুব অসুস্থ। আমার বন্ধু ইমাম নুফায়স বরকতপূরী ও বন্ধু শায়খ হাফিজ জুনায়দ সুবহান তার সরাসরি ছাত্র। জানতে পারলাম তিনি অনেক অসুস্থ, এমনকি তিনি হস্পিটালে আর থাকছেন না। জানতে পারলাম তিনি অর্থ কষ্টেও পড়েছেন। আমরা ল্যান্সবারী পার্ক মসজিদের চেয়ারম্যান ও ভাইসচেয়ারম্যানের অনুমতি নিয়ে মসজিদে শায়খের জন্য কিছু টাকা কালেকশান করলাম। জীবনে এই প্রথম শুনলাম একজন আলিম তার ছাত্ররা চিকিৎসার টাকা উঠায়েছে এটা ভালোভাবে নেন নি। তিনি মনে করেছেন, পৃথিবীর মানুষের কাছে হাত পাতা ঠিক না। যখন আমরা নিশ্চয়তা দিলাম এটা আমরা হাত পেতে টাকা উঠায়নি, বরং আমাদের উস্তায বলে মানুষ স্বেচ্ছায় এই অর্থ দিয়েছেন, এবং আরো দিতে চেয়েছেন, তখন মাত্র তিনি টাকা নিতে সাঁয় দেন। এবং আমাদের জন্য দুয়া করেন।
বিগত ২/৫/২০২৫ শুক্রবারে আমাদের মাথার তাজ, হৃদয়ের অনেক কাছের এই মুরব্বি ইন্তিকাল করেছেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলায়হি রাজিঊন। আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিয়ে জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন।
QnS is the contraction of ‘Qur’an and Sunnah’, the two principal sources of Islamic knowledge and intelligence.
Featured links
Get in touch
-
208-214 Romford Road, London E7 9HY.
-
qnslondon@gmail.com
-
+44 (0)2 7780 9460
Connect with us
-
Facebook
-
Twitter
-
Youtube
-
Instagram
-
Linkedin
-
Pinterest
Managed by QnS Webmaster Team Copyright © 2024 QnS London. All Rights Reserved.