Aug 13 / শাইখ ড. আবদুস সালাম আজাদী

জান্নাতে আপন ভাইবোনের সাথে দেখা হবে না?

ক’দিন ধরে জ্বালায়ে খাচ্ছে প্রশ্নকারীও কারিনীরা। উস্তায, জান্নাতে কি ভাই বোনের সাথে আমাদের সাক্ষাৎ হবেনা? প্রশ্ন এমনভাবে করে যেন আমি জান্নাত বেড়িয়ে এসেছি ক’মাস আগে!! আমি শুনি, আর হাসি। কারণ এই প্রশ্নকারীবা কারিনীরা মনে করে জান্নাত বাংলাদেশের ঢাকার শহরের মত, বা তার চেয়ে এট্টুসখানি বড়। ফলে ভাইবোন পাশাপাশি থেকেও একে অপরে দেখা করবেনা। হায়রে কী সর্বনাশ!!

আমি এই ধরণের প্রশ্ন এড়িয়ে যাই। কারণ ফাও কথা। জান্নাত সম্পর্কে পড়া শোনা করে তিনটি বিষয় আমার বিশ্বাসে এঁটে গেছে, এবং তা সরাবার সুযোগই নেই কোন ভাবে। 

একঃ জান্নাত হলো একেকজন জান্নাতির ব্যক্তিগত প্রতিদানের যায়গা। এখানে গোষ্টি, পরিবার, সমাজ বা রাস্ট্র কেন্দ্রিক কিছুই না। একেকজন জান্নাত (একটা), জান্নাতান (দুইটা) جَنَّاتٌ (বহু বহু জান্নাত) এর অধিকারী হয়ে সুখে শান্তিতে জীবন যাপন করবে। তার স্বাদ মিটাতে খাবার দাবার, সুখ মিটাতে অট্টালিকা, শখ মিটাতে খানি, দানি, ভ্রমন বা ইচ্ছামত ঘুরাঘুরির স্বাধীনতা, এবং মন মাতাতে নারী দিয়ে ভর্তি থাকবে। এমনকি সবচেয়ে মজার মজার ঘটনা তার জীবনে নিজের ইচ্ছ মত ঘটাতে থাকবে। এই ক্ষেত্রে কথা হলো, তোমার মন যা চাইবে, তুমি নিজের জন্য যা-ই দাবী করে তা সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাবে। 


দুইঃ মানুষের মধ্যে “মাদানিউত ত্বাব’ দান করা হয়েছে। কাজেই মানুষ বেশি আনন্দের জন্য মাঝে মাঝে বন্ধু বান্ধব, মা বাবা, সন্তান সন্ততির সাথে মেলা মেশা করতে চাইবে। এই ক্ষেত্রে কুরআন ও হাদীসের ভাষ্য একেবারে স্পষ্ট। জান্নাতী মানুষটা যাকেই দেখতে চাইবে, সাথে থাকতে চাইবে, পার্টি বা মস্তি করতে চাইবে আল্লাহ তা পূরণ করে দেবেন। তবে সে ক্ষেত্রে তিনি নিচের লোকদের উপরে আনবেন, উপরের লোকদের নিচে আনবেন না। সেক্ষেত্রে আল্লাহ বলেছেনঃ 


( وَالَّذِينَ آَمَنُوا وَاتَّبَعَتْهُمْ ذُرِّيَّتُهُمْ بِإِيمَانٍ أَلْحَقْنَا بِهِمْ ذُرِّيَّتَهُمْ وَمَا أَلَتْنَاهُمْ مِنْ عَمَلِهِمْ مِنْ شَيْءٍ كُلُّ امْرِئٍ بِمَا كَسَبَ رَهِينٌ ) الطور/21


যারা ঈমান এনেছে, এবং সন্তানেরা ঈমানের ক্ষেত্রে যদি তাদের অনুগামি হয়, তাহলে আমি তাদের সন্তানদেরকে তাদের সাথে মিলিয়ে দেবো। এবং তাদের আমল সামান্যও হ্রাস করবো না। প্রত্যেকেই তার আমলের কাছে দায়ী। (তূরঃ২১) এতে বুঝা যায় আত্মীয়রা আমলে দূর্বল হলেও উপরে থাকা আত্মীয়দের কাছে তারা যাবে, তবে উপর থেকে নিচে আসবে না, কারণ তাদের পদের অবমূল্যায়ন হবে। 


তিনঃ জান্নাতে যেয়েও মানুষ সামজিকতার টান অনুভব করবে। ফলে মানুষ তার বন্ধুদের, আত্মীয়দের, পরিচিতদের খোঁজ করবে মাঝে সাঝে। তারা ঈমানদার হয়েও জান্নাতে না থাকলে আল্লাহর কাছে তাদের ফিরে পাবার শাফায়াত বা সুপারিশ করে, এবং তা কবুল হবে। কেউ পদ-মর্যদায় নিচু হলে তাকে সুপারিশে উন্নত স্থানে রাখবেন। কিন্তু এক ছাদের তলায় দল বেঁধে বস্তির মত ঘুমানোর পরিবেশ বোধ করি থাকবেনা। সেখানে হবে যাতায়াত, একত্রে পার্টি। 


এই কথা গুলো বিশ্বাস করলে ভাই বোনদের সাথে দেখা হবেনা কথাটা একদম ভুল মনে হবে। কারণ হিসেবে আমরা কয়েকটি দলীল দেখিঃ 


১- আগের বর্ণিত সূরা তূরের ২১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ স্পষ্ট করে বলেছেন যে, ছেলে মেয়ে বাবা-মার ঈমান দ্বারা সুশোভিত হলে তারা তাদের বাবা-মার সাথে চাইলে মিলতে পারবে। এখন বাবা মার সন্তানেরা তো সম্পর্কে একে অপরে ভাই বোন। তা হলে কোন পাগলে বলছে ভাই-বোনদের জান্নাতে দেখা হবে না? মনে রাখা দরকার এই মিলিত হওয়া চিরস্থায়ী হবে বলে মনে হয়না। কারণ আপনি যে বোনের সাথে থাকতে চান, সেই কী আপনার সাথে থাকবে? বা থাকতে চাইবে? জান্নাত তো মানুষের স্ব স্ব আনন্দ, নিজে নিজেই জীবন যাপন ও আপন আপন ভোগের স্থান। 


২- আল্লাহ তাআলা বলেছেনঃ 


جَنَّاتُ عَدْنٍ يَدْخُلُونَهَا وَمَن صَلَحَ مِنْ آبَائِهِمْ وَأَزْوَاجِهِمْ وَذُرِّيَّاتِهِمْ ۖ   


চিরস্থায়ী জান্নাত, এতে (ঈমানদারেরা) প্রবেশ করবে, প্রবেশ করবে তাদের সৎ কর্মশীল বাবা-মা, জীবনসাথী, ও সন্তানেরা। (রা’দ, ২৩) 


ইবন কাসীর (র) এই আয়াতের ব্যখ্যায় বলেনঃ আল্লাহ তাদেরকে, তাদের বাবা-মা, পরিবার পরিজন, সন্তান সন্ততির মত মনের মানুষদের যারা জান্নাতে প্রবশের যোগ্যতা রাখে, সেখানে একত্রিত করবেন, যাতে করে তাদের চোখ জুড়ায়ে যায়।


মানুষ তার, বাবা-মা, সন্তান সন্ততি, ভাইবোন, আত্মীয় স্বজনকে দেখতে চায়, মিশতে চায় তাদের সাথে, স্মৃতি চারণ করতে চায় তাদের নিয়ে। এটাই আল্লাহ বলেছেনঃ 


وَفِيهَا مَا تَشْتَهِيهِ الْأَنفُسُ وَتَلَذُّ الْأَعْيُنُ ۖ وَأَنتُمْ فِيهَا خَالِدُونَ ‎﴿٧١﴾‏ 


 এবং তথায় রয়েছে মনে যা চায় এবং নয়ন যাতে তৃপ্ত হয়। তোমরা তথায় চিরকাল অবস্থান করবে। (যুখ্রুফঃ ৭১) এমন কোন মনুষ্য সন্তান আছে, যার মধ্যে আছে জান্নাতে যাবার যোগ্যতা, অথচ বাবা মা, ভাইবোন, ছেলে মেয়েদের কাছে নিতে মন চাইবেনা, অথবা চোখের তৃপ্তি নিতে আকাংক্ষী হবেনা?! তাই যদি হয়, তা হলে আল্লাহর চিরস্থায়ী নীতি, জান্নাতিদের যা মন চাইবে, তারা যা-ই দাবী করবে, আল্লাহ তা পূরণ করে দিবেন। 


৩- দেখুন আল্লাহ কী সুন্দর বলেছেনঃ 


وَنَزَعْنَا مَا فِي صُدُورِهِم مِّنْ غِلٍّ إِخْوَانًا عَلَىٰ سُرُرٍ مُّتَقَابِلِينَ ‎﴿٤٧
﴾‏
তাদের অন্তরে যে ক্রোধ ছিল, আমি তা দূর করে দেব। তারা ভাই ভাই হয়ে সামনা-সামনি আসনে বসবে। (হিজরঃ ৪৭) 


সাধারণতঃ মানুষে মানুষে মনে হিংসা, ক্রোধ, শত্রুতা বা জিঘাংসা নিয়ে দুনিয়ায় চলাচল করে। ওরা যখন জান্নাতে যাবে, কানত্বারাহতে তাদের মন থেকে ঐ সব মলিনতা আল্লাহ দূর করে দেবেন। এবং তারা ভাইভাই হয়ে যাবে। এই আয়াত তো অত্যন্ত সুন্দর ভাবে প্রাঞ্জল ভাষায় আমাদের বুঝাচ্ছে, শত্রুভাবাপন্ন মানুষদের ভাই ভাই বানাবে। আর ভাই বোন তো সেখানে আরো কাছের।  


আরো একটা কথা কিন্তু এখানে বলা হচ্ছে, তা হলো এই সব জান্নাতিরা খাটের উপর সামনা সামনি হয়ে বসবে। তার মানে এটা হবে যিয়ারাত। তারা একে অপরের সাথে দেখা করতে আসবে। এটা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। 


জান্নাতে মানুষের আড্ডা হবে, আনন্দের পার্টি হবে, বাজার হবে, ফ্যস্টিভাল হবে। সব চেয়ে আনন্দেরটা হবে “ইয়াওমুল মাযিদ”। এটা জান্নাতুল ফেরদাওয়সের একটা বিশাল উপত্যকা যেখানে সকল মুমিনেরা জুমুআর দিনে আল্লাহর সাথে কথা বলেবে। (আনাস থেকে বর্ণিত হাদীস, ইমাম শাফেয়ীর উম্ম)   


৪- আয়িশা সিদ্দীকা (রা) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ আমার উম্মাতের কোন এক ব্যক্তি যদি তার তিন মেয়েকে অথবা তিন বোনকে বড় করার দায়িত্ব নেয়, ফলে তাদের সাথে ভালো ব্যবহার করে, তা হলে তারাই হয়ে যাবে ঐ ব্যক্তির জন্য আগুণ থেকে বাঁচানোর দেয়াল। (তাবারনী, শায়খ আলবানি সহীহ বলেছেন) 


এই হাদীসে নিজের তিন বোনকে দয়া , মায়া, এডূকেশন ও ভালো ব্যবহার দিয়ে বড় করলে তারা তার জন্য জাহান্নাম থেকে বাঁচিয়ে জান্নাতে নেয়ার গ্যারান্টি হচ্ছে। (كُنَّ لهُ سِترًا من النارِ) যারা জান্নাতে নিচ্ছে তারা তার সাথে থাকবে কিনা, এই প্রশ্ন মনে আসলো কেন আমি বুঝি না। 


৫- ইমাম ইবনুল ক্বায়্যিম তার অনবদ্য গ্রন্থ حادي الأرواح إلى بلاد الأفراح এ আবু আয়্যুব থেকে বর্ণিত হাদীস দিয়ে প্রমান করেছেন যে, জান্নাতিরা একে অপরের কাছে যাতায়াত বা যিয়ারাত করবে। 


আনাস (রা) বলেন, রসূলুল্লাহ (সা) বলেছেনঃ 


إذا دخل أهل الجنة الجنة فيشتاق الإخوان بعضهم إلى بعض قال فيسير سرير هذا إلى سرير هذا وسرير هذا إلى سرير هذا حتى يجتمعا جميعا فيقول أحدهما لصاحبه تعلم متى غفر الله لنا فيقول صاحبه يوم كنا في موضع كذا وكذا فدعونا الله فغفر لنا" 


জান্নাতের অধিবাসীরা জান্নাতে প্রবেশ করার পর তাদের ভাইদের দেখতে আগ্রহী হবে। ফলে এর আসন ওর আসনের দিকে চলা শুরু করবে। ওর আসন এর আসনের দিকে চলতে শুরু করবে। যখন তারা একে অপরে মিলিত হবে, তখন একজন অপরজনকে বলবে, “তুমি কি জানো আল্লাহ আমাদেরকে কখন ক্ষমা করে দিয়েছিলেন? অন্য জন বলবে, উমুক দিন, যখন আমরা উমুক যায়গায় ছিলাম। আমরা দুইজন আল্লাহর কাছে দুয়া করেছিলাম, ফলে আল্লাহ আমাদের মাফ করে দেন”।  


এই হাদীস স্পষ্ট করে ফুটিয়ে তুলছে ভাই বোনদের সাথে জান্নাতে সাক্ষাতের মধুর দৃশ্য। 


এই ব্যাপারে দলীল এতো বেশি যে একত্রে এনে তার স্টাডী করলে কলেবর অনেক বড় হয়ে যাবে। আমার কাছে সব চেয়ে বেকুফের মতো মনে হয়েছে, আল্লাহ যখন বলছেন, মা-বাবা তাদের সন্তানদের কাছে পাবে। এখন এই মা-বাবার সন্তানেরা পরষ্পর যে ভাই বোন হয় এই সহজ জিনিষটা ইউটিউবার বা ফেইসবুকার রা জানতে বা বুঝতে পারলো না!! আল্লাহ আমাদের মূর্খতা দূর করে দিন।
আমীন।

Created with